Sunday, November 11, 2018

কী ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশে


বাংলাদেশে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে, আমরা তা ঠাহর করতে পারছি না। যারা আমার মতো বয়োবৃদ্ধ, তাদের মনে পড়ছে এই উপমহাদেশের দেশীয় রাজ্য কাশ্মির ও হায়দরাবাদের কথা। ব্রিটিশ শাসনামলে তদানীন্তন ভারতীয় উপমহাদেশে পাঁচ ভাগের দুই ভাগ ছিল, যাকে বলা হতো ‘দেশীয় রাজ্য’। এসব রাজ্য সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল না; ছিল দেশীয় শাসকদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের মেনে চলতে হতো ব্রিটেনের সঙ্গে বিশেষ ধরনের চুক্তি, যাকে বলা হতো ‘বাধ্যতামূলক বন্ধুতা’।
এসব রাজ্যের কোনো স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ছিল না। সবচেয়ে বড় দু’টি দেশীয় রাজ্য ছিল কাশ্মির ও হায়দরাবাদ। এই হায়দরাবাদের শাসককে বলা হতো নিজাম। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন ভারত উপমহাদেশ ত্যাগ করে চলে যায়। তখন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট পাস করে Indian Independence Act। এতে বলা হয়, দেশীয় রাজ্যগুলো হয় পাকিস্তান, নয় ভারত রাষ্ট্রে যোগ দেবে। অথবা তারা ইচ্ছা করলে থাকতে পারবে স্বাধীন। কাশ্মির ছিল মুসলিমপ্রধান দেশীয় রাজ্য, যার রাজা ছিলেন ডোগরাভাষী হিন্দু। তিনি যোগ দেন ভারতে। অন্য দিকে, হায়দরাবাদের শাসক বা নিজাম ছিলেন মুসলমান।
কিন্তু হায়দরাবাদ ছিল হিন্দুপ্রধান দেশীয় রাজ্য। হায়দরাবাদের নিজাম থাকতে চাইলেন স্বাধীন। হায়দরাবাদের মানুষের ভাষা হলো অন্ধ্রের মতো তেলেগু। তবে হায়দরাবাদের রাজকার্য ও লেখাপড়া চলত উর্দু ভাষার মাধ্যমে। কাশ্মির ভারতে যোগদান করার পর কাশ্মিরের মানুষ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু কাশ্মির সমস্যাকে নিয়ে যান জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে। নিরাপত্তা পরিষদে বলা হয়, কাশ্মির সমস্যা সমাধান করা হবে গণ-অভিমত গ্রহণ করে যা আজ পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি।

কাশ্মিরের একটা অংশ স্বাধীন হয়ে যায়, যাকে এখন বলা হয় আজাদ কাশ্মির। বাকি অংশ থাকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত। কাশ্মিরের একটা জেলাকে বলা হতো লাদাখ। এটা একসময় ছিল তিব্বতের অংশ। এখানকার মানুষ দেখতে অবিকল তিব্বতিদের মতো। ধর্মে এরা হিন্দু নয়, শিখ নয়; লামা বৌদ্ধ। চীন ১৯৬২ সালে যুদ্ধ করে লাদাখ দখল করে নেয়। এর আয়তন হলো ১২ হাজার বর্গমাইল। অর্থাৎ বর্তমান কাশ্মির হয়েছে ত্রিধাবিভক্ত। ‘আজাদ কাশ্মির’ কার্যত যুক্ত হয়ে পড়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে। লাদাখ যুক্ত হয়ে পড়েছে চীনের তিব্বতের সঙ্গে। কাশ্মির ও জম্মু যুক্ত আছে ভারতের সঙ্গে। তবে কাশ্মিরবাসী মুসলমানরা চাচ্ছেন স্বাধীন হতে।

অন্য দিকে, হায়দরাবাদের নিজাম স্বাধীন থাকতে পারেননি। ভারত হায়দরাবাদ দখল করে নেয়। হায়দরাবাদ দখলের কথা আমার মনে আসছে, কারণ ভারতের বিজেপি নেতা এবং লোকসভার সদস্য সুব্রামোনিয়াম স্বামী হুমকি দিচ্ছেন বাংলাদেশকে দখল করে নেয়ার। বাংলাদেশ ভারত দিয়ে তিন দিক ঘেরা। ভারত তাই সহজেই বাংলাদেশে পাঠাতে পারে তার সৈন্য। আর বাংলাদেশ হায়দরাবাদের মতোই হয়ে পড়তে পারে ভারতের অধীন। কেবল তাই নয়, ভারতের আসাম প্রদেশ থেকে প্রায় ১৩ কোটি বাংলাভাষী মুসলমানকে বাংলাদেশের মধ্যে ঠেলে দেয়ার কথা হচ্ছে। এটা করলে বাংলাদেশে সৃষ্টি হবে বিরাট মানবিক বিপর্যয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব তখন পড়বে হুমকির মুখে।
ভারত ধনী দেশ নয়। ভারতের পত্রপত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে, দেশটির অনেক অঞ্চলে অনেক কৃষক মারা যাচ্ছেন অনাহারে। তথাপি ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে এ বছর কিনল সাড়ে পাঁচ শ’ কোটি ডলারের অস্ত্রসম্ভার। প্রশ্ন উঠছে, ভারত এত অস্ত্র কিনছে কেন? এর একটা উদ্দেশ্য হতে পারে, বাংলাদেশ আক্রমণ করে তা দখল করা। তাই বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতিবিদদের প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। জাতীয় পর্যায়ে ভোট হলে আমরা তাতে অবশ্যই অংশ নেব। আমরা চাই, বাংলাদেশ একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হোক। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থায় গণতন্ত্রই কেবল আমাদের ভাবনার বিষয় হতে পারে না। ভাবনার বিষয় হওয়া উচিত, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য উচ্ছ্বাসে মনে হচ্ছে, আমরা আমাদের রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথা যেন বিস্মৃত হতে চাচ্ছি। তাই আমার এ কথা মনে করিয়ে দেয়া।
১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব রেখেছিল ‘স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস অ্যাগ্রিমেন্ট’ করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই চুক্তি করতে চায়নি। এর কারণ ছিল, ভারত ও চীনকে অসন্তুষ্ট না করা। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বিশেষভাবে বদলে গেছে। ভারত হুমকি দিচ্ছে বাংলাদেশকে দখল করার। অন্য দিকে, মূল চীনের হান চীনারা আরম্ভ করেছে চীনের মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার। চীনে সাধারণত দুই ধরনের মুসলমান দেখতে পাওয়া যায়। এক ধরনের মুসলমানকে বলা হয় উইঘুর। অন্য ধরনের মুসলমানকে বলা হয় হুই। উইঘুর মুসলমানেরা তুর্কি মুসলিম বংশোদ্ভূত। এরা বাস করেন মহাচীনের সিংকিয়াং বা জিনজিয়াং প্রদেশে। এরা একসময় ছিলেন স্বাধীন। খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে চীনের একজন মাঞ্চু রাজা এই অঞ্চল দখল করেন। সেই থেকে এ অঞ্চল হতে শুরু করে মহাচীনের অংশ হিসেবে বিবেচিত।
চীনের হুই মুসলমানেরাও প্রধানত তুর্কি বংশোদ্ভূত। কিন্তু তারা স্বেচ্ছায় চীনে আসেনি। এদের পূর্বপুরুষকে মধ্য এশিয়া থেকে চেঙ্গিস খান ধরে আনেন চীনে দাস হিসেবে কাজ করার জন্য। ওদের সঙ্গে চীনাদের মিশ্রণ ঘটেছে। তবে হুইদের বংশধররা পছন্দ করেছেন মুসলিম ধর্ম বজায় রাখতে। সম্প্রতি মূল চীনারা প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলমানকে বন্দী করেছে। আর করছে তাদের ওপর পীড়ন (TIME, October 1, 2018, P-8)। বাংলাদেশ একটা মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। তুর্কি মুসলমানদের ওপর, তারা মুসলমান ও তুর্কি বলে মূল চীনারা অত্যাচার করবে, এটা বাংলাভাষী মুসলমানকে ক্ষুব্ধ না করে পারে না। কেননা, বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যেও আছে মধ্য এশিয়া থেকে আগত তুর্কি মুসলমানদের প্রভাব। তাই এখন চীনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা হ্রাস পাচ্ছে। আর তারা সরে যেতে চাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে।
এখন যদি স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস অ্যাগ্রিমেন্টের অনুরূপ কোনো প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র প্রদান করে, তবে সেটা বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত হতেও পারে। সেটা তার জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই বিবেচিত হতে পারবে আবশ্যিক হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, রাশিয়া অথবা চীনের সঙ্গে হতে পারে তার একটা খুব বড় রকমের যুদ্ধ। তাই সে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে ‘মহাকাশ বাহিনী’ গড়ার। মনে করা হচ্ছে মহাকাশ যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, পৃথিবীকে সে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আর কেউ বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া, চীন ও ভারত কার্যত এ ইস্যুতে মিয়ানমারকে সমর্থন জানাচ্ছে। এ জন্যও বাংলাদেশকে ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে সরে যেতে হবে বলে মনে করা যায়। অনেকের ধারণা, মুসলমানেরা ধর্মান্ধ। কিন্তু মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কম ধর্মান্ধ নয়। তারা তাদের সরকারকে দিচ্ছে বিশেষভাবে সমর্থন। কিন্তু এ জন্য তাদের বলা হচ্ছে না, ‘বৌদ্ধ মৌলবাদী’; যদিও শব্দটা প্রয়োগ করলে তাদের ক্ষেত্রেও যে ভুল করা হয়, তা বোধহয় নয়। কথাগুলো আমার মনে পড়ছে, কেননা আমাদের দেশে একজন খ্যাতনামা নেতা হলেন বিখ্যাত চিকিৎসক বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
তিনি বলেছেন, তিনি এমন কোনো দলের সাথে জোট বাঁধতে তিনি প্রস্তুত নন, যারা মুসলিম মৌলবাদকে সমর্থন করে। কিন্তু বাংলাদেশে কি প্রবল মুসলিম মৌলবাদী দল আদৌ আছে? বাংলাদেশের দু’টি বড় রাজনৈতিক দল, একটি হলো আওয়ামী লীগ আর একটি হলো বিএনপি। এরা কেউই মুসলিম মৌলবাদী দল নয়। তিনি এ দুই দলের সাথে জোট বাঁধবেন কি বাঁধবেন না, সেটা তার রাজনৈতিক ভাবনার ব্যাপার। কিন্তু তা বলে মুসলিম মৌলবাদের ভীতি ছড়িয়ে নিজেকে প্রগতিশীল প্রমাণ করার চেষ্টা বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়াবাড়ি মাত্র।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
(Copy dailynayadiganta)
Previous Post
Next Post
Related Posts

0 comments:

Thanks for visit my website. Feel free discussion from my any post and I will happy for suggestions.